হাওজা নিউজ এজেন্সি: এই নিবন্ধে সৃষ্টিজগতে শৃঙ্খলা ও স্রষ্টার প্রজ্ঞা তত্ত্ব তুলে ধরছি:
গাছপালা ও প্রাকৃতিক শৃঙ্খলা
প্রতিটি গাছ নিজের প্রাকৃতিক গঠন ও বংশগত নকশা (genetic pattern) অনুযায়ী বিকশিত হয়।
তাই দেখা যায়—যে গাছ যেমন জাতের, তার ফলও ঠিক তেমনই হয়। ফলের স্বাদ, রঙ, গঠন এবং এমনকি পাতার আকৃতি ও বুননও স্থায়ী ও স্বতন্ত্র।
এটি প্রমাণ করে যে, প্রতিটি উদ্ভিদ তার অভ্যন্তরে এক নির্দিষ্ট নিয়ম ও জৈব নির্দেশনার অধীন।
সংযোজন ও বৈশিষ্ট্য স্থানান্তর
যখন কোনো গাছের ডাল বা শাখা অন্য গাছে পীচ (গ্রাফটিং) করা হয়, তখন সেই শাখার কিছু বৈশিষ্ট্য, যেমন—ফলের স্বাদ, গন্ধ বা রঙ, মূল গাছের ফলেও প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। এটি নির্দেশ করে যে এমনকি একটি শাখা বা কান্ডের মধ্যেও জীবনধারার প্রবাহ, শিরার গতিশীলতা ও জিনের প্রকাশ (gene expression) একটি গভীর সামঞ্জস্যপূর্ণ নিয়মে পরিচালিত হয়।
এই সূক্ষ্ম ভারসাম্যই প্রকৃতির অলৌকিক শৃঙ্খলার নিদর্শন।
মানবহৃদয়: নিরবচ্ছিন্ন জীবনের কেন্দ্রবিন্দু
মানবহৃদয় এমন এক শক্তিশালী ও অবিরাম কর্মরত পেশিবহুল পাম্প, যা প্রতিক্ষণ রক্ত সঞ্চালন করে শরীরের প্রতিটি অঙ্গে প্রাণ সঞ্চার করে। এটি ফুসফুস থেকে পরিশোধিত রক্ত গ্রহণ করে সারা শরীরে সরবরাহ করে। গড়ে প্রতিদিন এটি এক লক্ষ (১,০০,০০০) বারেরও বেশি স্পন্দিত হয়, এবং প্রায় সাত হাজার (৭,০০০) লিটার রক্ত পাম্প করে³। এই অবিশ্রান্ত ছন্দ, এই শৃঙ্খলাবদ্ধ তাল, সমগ্র জীবনজুড়ে অব্যাহত থাকে — যা এক মহাজাগতিক নিয়মের প্রাণবন্ত প্রতিচ্ছবি।
মস্তিষ্ক: জ্ঞান, চেতনা ও প্রজ্ঞার জালিকা
মানবমস্তিষ্ক এমন এক জটিল স্নায়ুব্যবস্থা,
যা অসংখ্য সংবেদন, তথ্য ও অভিজ্ঞতাকে সুশৃঙ্খলভাবে সঞ্চয় ও পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম। অগণিত স্নায়ুকোষের (neurons) পারস্পরিক সংযোগ ও ক্রিয়া দ্বারা মস্তিষ্ক গড়ে তোলে এক জ্ঞানভাণ্ডার ও বিশ্লেষণকেন্দ্র। প্রতিটি স্মৃতি, দৃশ্য বা অনুভূতি নির্দিষ্ট বিন্যাসে সংরক্ষিত থাকে, এবং প্রয়োজনমতো মুহূর্তেই তা মনে ফিরে আসে।
এই নিয়মিত সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের ক্ষমতা মানুষকে করে তোলে সচেতন, চিন্তাশীল ও সৃজনশীল।
চোখ: সৃষ্টির সূক্ষ্ম নকশার নিদর্শন
মানবচোখ এমন এক অদ্ভুতভাবে পরিকল্পিত অঙ্গ,
যা একদিকে সংরক্ষিত, অন্যদিকে দৃষ্টিসুবিধার জন্য উন্মুক্ত স্থানে অবস্থিত। চোখের চারপাশের হাড়ের গহ্বর (চোখের কোটর) যেন এক প্রতিরক্ষামূলক প্রাচীর, যা বাহ্যিক আঘাত থেকে চোখকে রক্ষা করে। পলকগুলো (eyelids) আলো নিয়ন্ত্রণ করে, চোখকে আর্দ্র রাখে ও ধুলোবালি থেকে সুরক্ষা দেয়। চোখের লেন্স বা ক্রিস্টালাইন দ্রুত ফোকাস পরিবর্তন করতে পারে, আর রেটিনা-র লক্ষ লক্ষ আলোকগ্রাহী কোষ প্রতি মুহূর্তে দৃশ্য গ্রহণ করে তা স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কে পাঠায়। সেখানে তাৎক্ষণিকভাবে চিত্রের বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা সম্পন্ন হয় — ফলে মানুষ পায় অবিচ্ছিন্ন, স্পষ্ট ও গতিশীল দৃষ্টিশক্তি।
সমগ্র জগৎ এক বৃহৎ, বোধগম্য গ্রন্থ — যার প্রতিটি পাতায় লেখা আছে নিয়ম, অনুপাত, সুষমা ও উদ্দেশ্য। এবং প্রতিটি গ্রন্থেরই যেমন একজন লেখক থাকে, তেমনি এই মহাবিশ্বেরও একজন পরিকল্পনাকারী ও স্রষ্টা আছেন।
এই সর্বব্যাপী শৃঙ্খলা — জীবজগতের ক্ষুদ্রতম কোষ থেকে শুরু করে নক্ষত্ররাজির অসীম মহাকাশ পর্যন্ত — এক জোরালো কণ্ঠে ঘোষণা করে: “এই সুবিন্যস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কোনো নিয়ন্ত্রক ছাড়া কখনোই হতে পারে না।”
ইমাম আলী (আ.)-এর বাণী
وَ تَحْسَبُ أَنَّکَ جِرْمٌ صَغِیرٌ وَ فِیکَ انْطَوَی العالَمُ الأکبَر**⁴
“তুমি কি ভাবো তুমি কেবল এক ক্ষুদ্র দেহমাত্র? অথচ তোমার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক বিশাল জগত, যেখানে জ্ঞানের, প্রজ্ঞার ও শৃঙ্খলার অপরিসীম ভাণ্ডার নিহিত।”
এই পবিত্র উক্তি মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে,
যেমন বাহ্যিক বিশ্বজগতে আল্লাহর নিখুঁত নকশা ও সুষমা পরিলক্ষিত, তেমনি মানুষের অন্তরেও বিদ্যমান এক আধ্যাত্মিক মহাবিশ্ব —
যেখানে সৃষ্টির রহস্য, জ্ঞান ও ঈশ্বরীয় প্রজ্ঞা প্রতিক্ষণ বিকশিত হচ্ছে।
পাদটীকা
হাক্কুল ইয়াকিন, আল্লামা শবর, পৃষ্ঠা ৭; আল-কাফি, আল-কুলাইনি, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৮০
ইনসান ও জাহান, পৃষ্ঠা ২২৯
ইনসান ও জাহান, পৃষ্ঠা ২১৪
মিরআতুল উকুল, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ২৭২; ওয়াফি, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৩১৯
মূল উৎস: উসুলে আকায়েদ — মুহাম্মদ তেরসলি
বিশ্বের প্রতিটি অণু, কোষ, তারকা ও জীবের অন্তরালে যে শৃঙ্খলা ও সামঞ্জস্য বিরাজ করছে, তা আল্লাহর অস্তিত্ব, প্রজ্ঞা ও মহিমার জ্বলন্ত প্রমাণ। মানুষ নিজেই এক ক্ষুদ্র মহাবিশ্ব, যেখানে এই শৃঙ্খলা, অনুপাত ও উদ্দেশ্যের প্রতিফলন স্পষ্টভাবে দেখা যায়। “সৃষ্টিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করো— প্রতিটি বিন্দুতে তুমি পাবে স্রষ্টার জ্ঞানের ছাপ ও প্রজ্ঞার আলো।”
আপনার কমেন্ট